স্মৃতি ও প্রেরণায় আহমদ মমতাজ
গতবছরের বইমেলাটা স্মরণীয় হয়ে থাকলো। স্মরণীয় হয়ে আছে এজন্যই, গেল বইমেলায় আমার সাথে পরিচয় হয়েছিলো বাংলা একাডেমির সহ-পরিচালক, লেখক ও গবেষক আহমদ মমতাজ স্যারের সাথে। যিনি মীরসরাইয়ের মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে কাজ করে গেছেন আমৃত্যু। উনার কলমে উঠে এসেছে মীরসরাইয়ের ঐতিহ্য ও সোনালি দিনের ইতিহাস। চট্টগ্রাম ও মীরসরাইয়ের ঐতিহাসিক স্থান, স্থাপনা, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ ও মনীষাদের নিয়েই কাজ করতেন তিনি। এই কঠিন কাজরে যেমন ভালোবেসে আপন করে নিয়েছেন ঠিক তেমনই আপন হয়ে বেঁচে থাকবেন হাজারো মানুষের মননে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছিলো বইয়ের স্টলে, প্যাভিলিয়নের আলোয় আলোয়। আমি আর নূরউদ্দিন সবুজ ভাই, বই ও বাতির আলোতে নানান বিষয়ে গল্প করলাম। লেখালেখি নিয়ে আলাপের এক পর্যায়ে জানালেন আহমদ মমতাজ স্যারের কথা। এরপরই হাঁটতে হাঁটতে স্যারের সাক্ষাতে বাংলা একাডেমির দক্ষিণের দরজা দিয়ে দু\"তলায় হাজির হলাম। সবুজ ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন হাস্যোজ্জ্বল ও প্রানবন্ত এই মানুষটার সাথে। স্যারের গ্রামের বাড়ি আমাদের এলাকায় হওয়াতে মনের অলিন্দে অজানা এক আনন্দ অনুভব করলাম।
প্রাথমিক কথার ইতি টেনেই আলাপ শুরু করলেন অপার সম্ভাবনার দুয়ার মীরসরাইয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে। খুব সুন্দর ও প্রাঞ্জল ভাষায় কথা বলেন। দীর্ঘ আলাপ হলো। এই আলাপে তুলে এনেছেন মীরসরাইয়ের বিভিন্ন বিষয় ও নানান সময়ের পটপরিবর্তনের কথা। উনি নানান প্রসঙ্গে কথা বলেই যাচ্ছেন, আমি আর সবুজ ভাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে গেলাম কোন ধরনের বিরাম ও ক্লান্তি ছাড়াই। কথার ফাঁকে চায়ের টানে যেটুকু বিরতি, সেখানে গিয়ে থামলেন।
প্রসঙ্গক্রমে অনেকের কথাই বললেন। সেই সাথে জানালেন নানান পরিকল্পনার কথা। হাসিমুখে বললেন, বইমেলা শেষে গ্রামে যাবো। তারপর আরো কথা হবে, ( যদিও করোনা পরিস্থিতির কারণে আর দেখা হওয়ার সুযোগ হয়ে উঠেনি, তবে যোগাযোগ হয়েছে আরো বেশ কয়েকবার পজিটিভ মীরসরাই পত্রিকা ও নানান বিষয়ে) মীরসরাই নিয়ে অনেক কাজ করতে হবে, সেই কাজের সহযাত্রী হতে হবে তোমাদেরও। উনার কথা শুনে প্রাণিত হলাম খুব। ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় বুক বাঁধলাম। মনে হলো এ যেন নতুন ছায়ায় আশ্রয় পেলাম। পেলাম নতুন প্রেরণার ঠিকানা। এইসব এখন স্মৃতি হয়ে জমে আছে বুকে।
আলাপ চলতে চলতে প্রায় রাত নয়টা বেজে এলো। চার দেয়ালে স্যারের তথ্য সমৃদ্ধ ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় টেরই পাইনি সময় গড়িয়ে এলো এতটা। একাডেমি বন্ধের তাড়া না থাকলে এই আলাপে সম্ভবত রাত পেরিয়ে যেতো। বিদায় নেয়ার আগেই উনার লেখা "শমসের গাজী " বই ও একটি ম্যাগাজিন উপহার দিয়েছিলেন। এই ছবিটা সেই আলাপের স্মৃতি হয়ে থাকবে আজীবন।
মানুষকে সহজেই কতোটা আপন করে নেয়া যায় তা স্যারের প্রথম দেখাতে টের পেয়েছি। অনুভব করেছি হাসিমুখে কথা বলে কিভাবে দখলে নেয়া যায় মানুষের হৃদয়। এমন মাটি ও মনের মানুষটা ইন্তেকাল করলেন গত রোববার (৯ মে) ভোরে। ঠিক কদর রাতের আগেই। উনার মৃত্যু খবরের আঘাতে একটা পাথর জমা হলো বুকে। সেই সাথে আরো কষ্ট পেলাম করোনা পরিস্থিতির কারণে শেষ দেখাটা না হওয়াতে। সুখ ও স্মৃতি ভোলা যায় না। যেমনটা ভুলতে পারছি না স্যারকে। ব্যথার এই ভাষা প্রকাশের সাধ্য আমার নাই। মহান রবের কাছে এই প্রার্থনাই থাকলো যেন স্যারকে ক্ষমা করে জান্নাতের শীতল পরশের মেহমান করে নেয়। [আ-মীন।] সেই সাথে পরিবারকে ধৈর্যের সাথে বাকি পথ পাড়ি দেয়ার তৌফিক দেয়।
শেষকথা হলো, স্যারের মৃত্যুতে দেশ ও জাতির যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো এই ক্ষতিটার টের পাবে মীরসরাইয়ের মানুষ। মীরসরাই নিয়ে স্যারের যে অনস্বীকার্য কাজের অবদান তা কাল থেকে কালান্তরে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
