করোনার দীর্ঘসময় গেলো ভয়-আতঙ্ক ও নানান সংকটে। উপন্যাসে প্রবাস জীবনের এই সংকটের আলাপ উঠে এসেছে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র ও গল্পে। যারা প্রবাসে থাকেন তাদের বুকে একটা হাহাকার ও শূন্যতা কাজ করে। এই শূন্যতা হলো পরিবারের। কাছে না থাকার, কাছে না পাওয়ার। এই উপন্যাসের শুরুতে যেমন অতশীর আকুতি ছিল বাবাকে কাছে পাওয়ার, বাবাকে দেখার। বাবার কাছে তার একটাই প্রশ্ন, বাবা তুমি আসো না কেন? এটা আপাতদৃষ্টিতে শুধু মেয়ের আকুতি হলেও মূলত এই শূন্যতা, এই হাহাকার পুরো পরিবারের। ইরার। আবিদের প্রতি ইরার যে আবেগ, আবেদন ও ভালোবাসা তারও একটা টানটান অনূভুতির ছোঁয়া পাওয়া যাবে। গল্পের মাঝে দেখা মিলবে প্রেম, বিরহ ও বিচ্ছেদের ঘটনায় ফাহমিদা ও মনিরকে।
উপন্যাসে উঠে এসেছে করোনা মহামারীর সময় দুবাই শহরের চিত্র। বদলে দিয়েছে শহর, মানুষ ও জীবনের রূপরেখা। করোনার এমন সংকট ও আতঙ্কে মানুষ বাঁচার জন্য কীভাবে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। করোনার এই সময়ে অন্য আরো দেশের তুলনায় দুবাই যে কত সচেতনতা ও সর্তকতা নিয়ে সামনে এগিয়ে এসে তার একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে এই উপন্যাসে। দুবাইয়ের বর্ণিল শহর থেকে শুরু করে এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সচেতনতায় যে অনন্য ভূমিকা রাখল তারই একটি দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে এই আলাপে।
করোনার এই বৈশ্বিক মহামারীতে ভয়ঙ্কর ঢেউ এসে লাগে দুবাই শহরেও। চারদিকে জারি করা হয়েছে লকডাউন। চৌকস প্রশাসনিক নিরাপত্তা বলয়ে ঘেরা সারা দুবাই। পত্র-পত্রিকায় আসছে প্রশাসনের কঠোর হুঁশিয়ারি বার্তা। এই মহামারিতে তখন শত শত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে করোনায়। এমন পরিস্থিতিতে শুরু হলো চিরচেনা দুবাই শহরে নতুন এক পৃথিবীর যাত্রা। গল্পের পরতে পরতে মহামারির কঠোর পরিস্থিতির বর্ণনা তুলে এনেছেন লেখক। ঘরবন্দী মানুষের কাছে বারবার ছুটে যাচ্ছে বাঙালি কমিউনিটির লোকজন। স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে নিরলস কাজ করে গেছেন কমিউনিটি টিম ও রেবেকারা। নাইফ ছাড়াও দুবাইয়ে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় হৃদয়বান ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিলেন সাহায্যের হাত। এগিয়ে গেলেন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন। করোনার যে ভয়াল থাবা তাতেই প্রাণ হারালেন অনেকেই, না ফেরার পথে পাড়ি জমালেন মাহবুব। প্রবাসে এমন মৃত্যু আত্মীয়-স্বজনের অপেক্ষা বাড়ায়, দীর্ঘ করে তোলে শোকের মাতম। কিন্তু কে পাঠাবে কার লাশ! দেশে লাশ পাঠানোর একটা বিরাট ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয় প্রবাসীদের। এ নিয়েও তুলে এনেছেন নানান সংকটের চিত্র।
বিশ্বময় এমন দুঃসময়ে অনেকেই পড়েছেন বিপাকে। কেউ কেউ বিভিন্ন কোম্পানী বা মালিকানায় থাকায় পড়েছেন বেতনন বিড়ম্বনায়। আবার কেউ কেউ কাজ না থাকায় হয়েছেন ক্যানসেল, খালি হাতে ফিরেছেন দেশেও। অনেক কোম্পানি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শ্রমিকের যে বেতন তাতেও ফাঁকি দিয়েছে। এজন্য নিয়েছে নানান তথ্য বিভ্রান্তি ও লুকোচুরির আশ্রয়। এতে যেমন একদিকে ক্ষতির মুখে পড়ে কফিল, জহির ও ফিরোজদের মতো সাধারণের শ্রমিক, অন্যদিকে করোনার ভয়াল গ্রাসে কেড়ে নিয়েছে তাদের দু'মুঠো ভাত কিংবা দু'বেলা আহারও। এসব হতাশা ও দুর্দশার মাঝেও কিছুটা স্বস্তির দেখা পেতে বাংলাদেশ সরকার যে অনুদান দিয়েছিলো তাও ঠিকঠাক পৌঁছায়নি বাঙালি প্রবাসীদের হাতে। সেগুলো কোন এক দৈব কারণে হাওয়া হয়ে যায়। এতে এই দুর্যোগে হতাশায় আরো অন্ধকার নেমে আসে বাঙালিদের ভাগ্যাকাশে।
আলো ঝলমলে দুবাই শহর উপভোগ করতে আসেন অনেকেই। ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন ভ্রমণ বিলাসী পর্যটকরা। দেশ ও বিদেশের পর্যটকরা এই দুবাইকে আখ্যায়িত করেন রাতের শহর হিসেবে। স্বপ্নের দেশ হিসেবে। লেখক এই উপন্যাসে দেখিয়েছেন দুবাই শহরের সৌন্দর্য, আলোকসজ্জা, স্থাপত্যশৈলীর বাহার, প্রযুক্তির নিখুঁত ব্যাবহার কিংবা ভবিষ্যতের দুবাই শহরের দৃশ্যপট। এই শহরের বর্ণনায় মনে হবে, এ যেন ভোগ- বিলাসের সমস্ত আয়োজন করে রেখেছে দুবাই।
সর্বোপরি, বলা যায় লেখকের এই উপন্যাস নানান পট-পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে করোনা মহামারির সময়ে দুবাই ও বাংলাদেশ যে ক্রান্তিকাল পার করেছে তারই একটি সরল উপস্থাপন। এতে যেমন ফুটে উঠেছে এই দুবাই শহরের সৌন্দর্য, চৌকস ও দূরদর্শী প্রশাসনিক নিরাপত্তার বর্ণনা তেমনি এসেছে প্রবাসীদের হাহাকার, দুঃখ দুর্দশা, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির কথা।
তো, এতোক্ষণ যে বইটার আলাপ করছিলাম— "ঘরে ফেরার গান"। অক্টোবর দুই হাজার বাইশ দুবাই-বাংলাদেশ বই মেলায় প্রকাশিত হয়। লেখক, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক কামরুল হাসান জনি'র এটা তৃতীয় উপন্যাস। প্রকাশ করেছে বইয়ের জগতে বিশ্বস্ত নাম দাঁড়িকমা। প্রকাশক আবদুল হাকিম ভাই যে বেশ যত্ন ও আন্তরিকতা নিয়া বইয়ের কাজ করেন, এটা তার আরেকটা নমুনা। প্রচ্ছদেও গল্পের ভাবনা দারুণ ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী সোহানুর রহমান অনন্ত। বইয়ের মূল্য পাঠক মহলের অনুকূলে রাখতেই নির্ধারন করা হয়েছে মাত্র দুইশত পঞ্চাশ টাকা।